সারওয়ার মো: সাইফুল্লাহ্ খালেদ:
এ পৃথিবী গ্রহে মানব বসতি স্থাপনের জন্মলগ্ন থেকেই বিভিন্ন সময়ে মানুষ নানাবিধ ছোট বড় রোগবালাই ইত্যাদিতে আক্রান্ত হয়েছে এবং হচ্ছে। এসব রোগবালাই কখনো কখনো এমন ব্যাপক এবং ভয়াবহ রূপ ধারণ করে যে, এতে বহু লোক প্রাণ হারান। এ সব রোগবালাইয়ের মধ্যে আছে গুটি বসন্ত, প্লেগ, ম্যালেরিয়া, কলেরা, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ইত্যাদি। ১৯১৮ সালে বিশ্বব্যাপী ‘স্প্যানিশ ফ্লুতে’ অন্যূন পাঁচ কোটি লোক মারা যান। সাম্প্রতিককালের মহামারী কোভিড-১৯ ছাড়া আর অন্য সব রোগেরই কোনো না কোনো কার্যকর প্রতিষেধক বা নিরাময়ের কোনো না কোনো ওষুধ আবিষ্কৃত হয়েছে; যদিও এ কাজে যথেষ্ট সময় লেগেছে। কোভিড-১৯ নিরাময়ের ওষুধ বা প্রতিষেধক আবিষ্কারের চেষ্টা চলছে। কোনো কোনো দেশ যেমন চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া এ রোগ নিরাময়ের সার্থক ওষুধ আবিষ্কার এবং এর সফল প্রয়োগের দাবি করছে। তবে এ রোগ নিরাময়ের সর্বজনগ্রাহ্য ওষুধ আজ প্রর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়েছে বলে নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছেন না। সবই প্রায় পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর্যায়েই আছে। পুঁজিবাদী কায়দায় উন্নত দেশগুলোর মধ্যে এ বিধ্বংসী রোগের প্রতিষেধক কিংবা ওষুধ আবিষ্কার করার প্রতিযোগিতা যে চলছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কোভিড-১৯ সম্পর্কে ব্রিটিশ সরকারের জরুরি পরিস্থিতিতে বৈজ্ঞানিক পরামর্শক কমিটির সদস্য স্যার মার্ক ওয়ালপোর্ট মন্তব্য করেছেন, কোভিড-১৯ কোনো না কোনো আদলে আমাদের সাথে আজীবন থাকতে পারে (দৈনিক নয়া দিগন্ত, ২৪ আগস্ট ২০২০)।
কোভিড-১৯ এর মতো একটি বিধ্বংসী রোগ নিরাময়ের ওষুধ কিংবা এর প্রতিষেধক আবিষ্কার অতি সহজেই সম্ভব হয়ে যাবে বলে মনে হয় না। আল্লাহ বলছেন : ‘আর আপনার রব (প্রভু) জনপদসমূহকে ধ্বংস করেন না, যে পর্যন্ত না তিনি তার কেন্দ্রস্থলে রাসূল প্রেরণ করেন, যিনি তাদের কাছে আমার আয়াতসমূহ তেলাওয়াত না করেন এবং আমি তো জনপদসমূহকে কেবল তখনই ধ্বংস করি, যখন তার অধিবাসীরা জুলুম করে’ (সূরা কাসাস ২৮ : আয়াত ৫৯)। আখেরি নবী সা: আল্লাহর কালাম কুরআন দিয়ে গেছেন। আল্লাহ বলেন ‘আর আপনার রব যদি চাইতেন, তবে পৃথিবীতে যারা আছে তারা সবাই সমবেতভাবে ঈমান আনত। তবে কি আপনি মানুষের ওপর জবরদস্তি করবেন যাতে তারা মুমিন হয়ে যায়?
আল্লাহর হুকুম ছাড়া কারো পক্ষে ঈমান আনা সম্ভব নয়। আর তিনি অপবিত্রতা আরোপ করেন তাদের প্রতি যারা অনুধাবন করে না। আপনি বলুন : তোমরা লক্ষ করো, আসমান ও জমিনে কী রয়েছে! আর নিদর্শাবলি ও ভয় প্রদর্শন সেসব লোকদের কোনো কাজে আসে না যারা ঈমান আনে না। তবে কি তারা তাদের আগে যা ঘটে গেছে তার অনুরূপ ঘটনারই অপেক্ষায় আছে? আপনি বলে দিন : তবে তোমরা প্রতীক্ষা করতে থাকো, আমিও তোমাদের সাথে প্রতীক্ষাকারীদের মধ্যে শামিল আছি। অবশেষে আমি রক্ষা করি আমার রাসূলদেরকে এবং তাদেরকে যারা ঈমান এনেছে। এমনিভাবে মুমিনদের রক্ষা করা আমার দায়িত্ব’ (সূরা ইউনুস ১০ : আয়াত ৯৯-১০৩)। কোভিড-১৯ ভাইরাসের শেষ পরিণতি সেটাই হবে বলে মনে হয়। তবে কে মুমিন বা মুত্তাকি তা আল্লাহ তায়ালাই ভালো জানেন।
এখানে মুসলমানদের সফলতার জন্য আল্লাহ তাদের ঈমানের ওপর জোর দিয়েছেন; যেটা আজ কিছু পোশাকী ও নাফরমান মুসলমানদের মধ্যে লক্ষ করা যায় না। নিজে আরবি বুঝি না বলে বিশ্বকোষসদৃশ কুরআন বুঝতে বিশিষ্ট আলেমদের ইংরেজি ও বাংলা অনুবাদ পড়ি এবং কুরআনে কী আছে সে সম্বন্ধে ধারণা লাভ করার চেষ্টা করি। যদি কোনো সূরার কোনো আয়াত বুঝতে আমার অসুবিধা হয় সে ক্ষেত্রে অনূদিত কয়েকটি কুরআন মাজিদ দেখে সে আয়াতটির যথার্থ তাৎপর্য কী তা বুঝতে চেষ্টা করি। অনেক বিশ্বখ্যাত আলেম যেমন ভারতের ডা: জাকির নায়েক (বর্তমানে মালয়েশিয়া আছেন) এবং দক্ষিণ আফ্রিকার আহমদ দি’দাত প্রমুখ আলেম উপদেশ দিয়েছেন নিজ ভাষায় অনূদিত কুরআন বুঝে পড়তে। আমি তাদের সাথে একমত। না বুঝে আরবি ভাষায় কুরআন পড়ার চেয়ে বুঝে মাতৃভাষায় কুরআন পড়াই উপকারী এবং তা আমল করা সহজ। আল্লাহ্ বলেন : ‘আমি তো আপনার ভাষায় কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি, যেন আপনি এর সাহায্যে মুত্তাকিদেরকে সুসংবাদ দিতে পারেন এবং কলহপ্রবণ লোকদেরকে সতর্ক করতে পারেন’ (সূরা মারইয়াম ১৯ : আয়াত ৯৭)। আল্লাহ্ আরো বলেন : ‘আমি পাঠিয়েছি প্রত্যেক রাসূলকে তার কওমের ভাষায় যেন সে স্পষ্টভাবে তাদের কাছে বর্ণনা করতে পারে’ (সূরা ইবরাহিম ১৪ : আয়াত ৪)। শেষ রাসূল মুহাম্মদ সা: জন্মেছিলেন মক্কার এক সম্ভ্রান্ত কুরাইশ বংশে যার ভাষা ছিল আরবি, যে কারণে আরবিতে কুরআন নাজিল হয়। কোনো বিষয় বুঝতে হলে মাতৃভাষার বিকল্প নেই। আরবি কুরআন বিভিন্ন ভাষাভাষী মুসলমানদের জন্য তাদের নিজ নিজ ভাষায় অনূদিত হয়েছে যেন তারা তা বুঝতে পারেন। তবে আরবি ভাষায় কুরআন বুঝে পড়াতে অধিক সওয়াব।
সমগ্র কুরআনে যা আছে তা তুলে ধরতে বিশেষ কয়েকটি আয়াতই যে যথেষ্ট নয় তা বুঝতে হবে। কুরআন নামক এ মহাগ্রন্থের অর্থ বুঝতে হলে দু’চারটি আয়াতের উদ্ধৃতিই যথেষ্ট নয়, পূর্ণাঙ্গ কুরআন মাজিদই পড়তে হবে এবং তা মান্য করে চলতে হবে। কোভিড-২০১৯ নামক যে কঠিন মহামারী আজ সারা বিশ্বকে গ্রাস করেছে তার কারণ ও নিরাময় খুঁজতে হলে বর্তমানে আমাদের নিত্যদিনের কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি মানুষের প্রাত্যহিক জীবনযাপনে কুরআনে আল্লাহ্ কী নির্দেশ দিয়েছেন তা সচেতনভাবে যাচাই করে দেখতে হবে। আল্লাহ্ বলেন ‘যারা শাশ্বত বাণীতে (কুরআন) বিশ্বাসী আল্লাহ্ তাদের সুপ্রতিষ্ঠিত রাখবেন পার্থিব জীবনে ও আখিরাতে এবং যারা সীমালঙ্ঘনকারী আল্লাহ্ তাদের রাখবেন বিভ্রান্তিতে। আল্লাহ্ যা ইচ্ছা করেন, তা-ই করেন’ (সূরা ইবরাহিম ১৪ : আয়াত ৩, ১৬-১৭)। বর্তমানকালে পার্থিব ভোগ বিলাসের প্রতিই মানুষের আকর্ষণ প্রবল এবং আখিরাতের বা পরকালের ব্যাপারে তারা উদাসীন। আল্লাহ্ আরো বলেন : ‘আর আমি কোনো জনপদ ধ্বংস করিনি, কিন্তু তার জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় লিখিত ছিল। কোনো জাতি তার নির্দিষ্ট সময়কে ত্বরান্বিতও করতে পারে না এবং বিলম্বিতও করতে পারে না (সূরা হিজর ১৫ : আয়াত ৪-৫)। ঈমানদার মুসলমানরা অবশ্যই বিশ্বাস করবেন, যে আজার আজ বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছে তা আল্লাহ্র পূর্ব নির্ধারিত বিষয়। কুরআনের ভাষায় বলতে গেলে নির্দিষ্ট অবকাশের পর আল্লাহ্ মানবজাতিকে পাকড়াও করেছেন। আল্লাহ্ প্রদত্ত এই অবকাশকালে তারা কুরআন ও রাসূল সা:কে অমান্য করে সীমা লঙ্ঘন করেছে।
কুরআনের বিভিন্ন রূপ ব্যাখ্যা বা তফসিরের ভিত্তিতে বিশ্বব্যাপী ১৮০ কোটি (বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ২৪.১ শতাংশ) মুসলমানদের প্রায় ৭৩টি ‘সেক্টে’ আজ বিভক্ত। এর মধ্যে প্রধান দুটি সেক্ট- ‘সুন্নি ও শিয়া’ মুসলমানদের সংখ্যা যথাক্রমে ১৫০ কোটি (৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ) এবং ২.৪০ কোটি থেকে ৩.৪০ কোটি (১৫ খেকে ২০ শতাংশ)। তবে তারা সবাই এক আল্লাহ ও কুরআনে বিশ্বাস রাখেন। আমার মনে হয়, বাংলাদেশের আলেমদের রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে কুরআনের ব্যাখ্যা বিশ্লষণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। আমার অনুমান ভুলও হতে পারে। তবে কুরআনের সঠিক ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের ভিত্তিতে বিশ্বব্যাপী একটি ঐক্যবদ্ধ মুসলিম সমাজ প্রতিষ্ঠা করা মুসলমানদের স্বার্থেই জরুরি। এছাড়াও ইহুদি ও নাসারারাও তাদের নিজ নিজ সঠিক তাওরাত ও ইঞ্জিল যা কুরআন প্রত্যয়ন করেছে তা পাঠ করে থাকেন।
তবে ইহুদি ও নাসারাদের মধ্যে পুরোহিততন্ত্রের প্রচলন হয়েছে। কিন্তু ইসলাম ধর্মে তা নেই এবং থাকার কথাও নয়। কারণ ইসলামে আল্লাহ্র সাথে তার বান্দার যোগাযোগ সরাসরি; তা কোনো ব্যক্তির বা কোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নয়। হালে ইসলাম ধর্ম পুরোহিতন্ত্রের দিকে ধাবিত হচ্ছে বলে মনে হয়। কারণ মাদ্রাসার ছাত্র এবং শিক্ষকদের মধ্যে এর পৌরহিত্য সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে বলে মনে হয়। এছাড়াও সাধারণ মুসলমানরা নামাজ রোজা ইত্যাদি পালন করলেও তাদের আমল বড় দুর্বল। ইহুদি নাসারা নানাবিধ পাপ কর্মে জড়িত, যেমন মদ, জুয়া, ক্যাসিনো কালচার প্রভৃতি তাদের মধ্যে বিস্তৃতি লাভ করেছে এবং এর ডেমোনেস্ট্রেশন ইফেক্টে’র কারণে মুসলমান সমাজেও তা বিস্তৃত হচ্ছে। এটাকেই আজকের দুনিয়ায় আধুনিকতা বলে ধরে নেয়া হচ্ছে। এক কথায় বিশ্ব আজ নানাবিধ পাপে নিমজ্জিত। মনে হয় আল্লাহ্র বিবেচনায়, মানবজাতি পাপ কর্মে সীমালঙ্ঘন করেছে। কুরআনের অনেক জায়গায় উল্লেখ আছে, সীমালঙ্ঘনকারীকে আল্লাহ্ পছন্দ করেন না। এরই আজাবস্বরূপ বর্তমানে কোভিড-২০১৯ বিশ্বকে গ্রাস করেছে বললে মিথ্যা বলা হবে কি?
কুরআনে আল্লাহ্ বলেন : ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ্ ক্ষমা করেন না তাঁর সাথে শরিক করার অপরাধ; তবে তিনি ক্ষমা করেন এছাড়া অন্যান্য অপরাধ যাকে ইচ্ছা করেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ্র সাথে শরিক সাব্যস্ত করে সে তো এক মহাপাপে লিপ্ত হয়’ (সূরা নিসা ৪ : আয়াত ৪৮)। আজকাল আল্লাহ্র সাথে শিরক করাটা বুঝেই হোক আর না বুঝেই হোক, মানুষের জন্য একটি নিত্যদিনের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজকের বিশ্ব এবং দেশীয় রাজনীতি ও সামাজিক আচারে স্বীয় স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় হোক কিংবা ধর্মীয় আদেশ নির্দেশ সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণেই হোক, আল্লাহ্র সাথে বিভিন্ন লেভেলের মুসলমান ও অমুসলমানদের আল্লাহ্র সাথে শরিক করতে দেখা যায়। এমনটা হওয়ার প্রধান কারণ ধর্ম বিষয়ে তাদের সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ জ্ঞানের অভাব। মুমিনদের শিরককারীদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা নাজায়েজ। আল্লাহ্ বলেন : ‘নবী ও মুমিনদের জন্য উচিত নয় যে, তারা ক্ষমা প্রার্থনা করবে মুশরিকদের জন্য যদি তারা নিকট আত্মীয়ও হয় যখন তাদের কাছে এ কথা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, তারা জাহান্নামি” (সূরা তওবা ৯ : আয়াত ১১৩)। এ ক্ষমা কবুল যোগ্য নয়; তাই আল্লাহ্ তা করতে নিষেধ করেছেন।
আজকের দিনে জ্ঞানবিজ্ঞান বহুদূর এগিয়ে গেছে এবং মানুষের ধর্র্ম বিশ্বাসেও চিড় ধরেছে। এটা হওয়ার কথা ছিল না। এ বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক আইনস্টাইন বলতেন Religion without science is blind and Science without religion is lame’. (বিজ্ঞান ব্যতিরেকে ধর্ম অন্ধ আর ধর্ম ব্যতিরেকে বিজ্ঞান খোঁড়া)। বিজ্ঞান ও ধর্ম একে অপরের পরিপূরক। তবে একথা মনে রাখতে হবে যে, প্রথম মানব আদম আ:-এর কাল থেকে ইসলাম ধর্ম চলে আসছে এবং রাসূলে করিম সা:-এর কালে এসে এটা পূর্ণাঙ্গতা লাভ করেছে আর কিয়ামত পর্যন্ত তা চলবে। বিজ্ঞান যতদূরই এগিয়ে যাক না কেন ধর্মকে আশ্রয় করেই অবিকৃত বিজ্ঞান কেয়ামতের আগ পর্যন্ত এগুবে। তাই ধর্মকে উপেক্ষা করে কিছুই অর্জন করা যাবে না।
লেখক : অর্থনীতির অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও ভাইস প্রিন্সিপাল কুমিল্লা মহিলা সরকারি কলেজ